স্মার্ট কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার
সমীরণ বিশ্বাস
কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সে সাথে স্মার্ট কৃষিতে পরিণত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার অন্যতম।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন করা সম্ভব নয় এমন ক্ষেত্র খুব কমই আছে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের জন্য কৃষি একটি উজ্জ্বল ক্ষেত্র। ইতোমধ্যে কৃষিতে উন্নত দেশ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চীন, ভারতসহ অনেক দেশ কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার শুরু করেছে। আর এগুলো উৎপাদনকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষিকাজকে করেছে ব্যাপক সহজ। জমি রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে কৃষির মোটামুটি সব ক্ষেত্রেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুব দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে।
ইন্টারনেট অব থিংকস (IOT), রোবটিক্স, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বিগ ডাটা, থ্রিডি প্রিন্টিং, সব উপাদানসমূহ নিয়েই স্মার্ট এগ্রিচালচার গঠিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে লেন্স জুম ব্যবহার করে মেশিনকে আকার ও টেক্সচার সম্পর্কিত ধারণা প্রদান করা যায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্বলিত প্রযুক্তির মাধ্যমে ফসল উৎপাদন, মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, আগাছার উপস্থিতি, আগাম ফসল ব্যবস্থাপনা ফুল, ফল এর সময় নির্ণয়, ফসলের সম্ভাব্য পরিমাণ ইত্যাদি নির্ণয় করা যায়। সার ও বালাই ব্যবস্থাপনাও খুব সহজেই করা যায়। ফলশ্রুতিতে কৃষিক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ খুব দ্রুতগতিতে বাড়ছে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলা যায় ভবিষ্যতের কৃষি ও কৃষককে সুরক্ষা দিতে স্মার্ট কৃষিতে রূপান্তরিত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। ক্রপ মডেলিং, প্রিসিসন এগ্রিকালচার এখন ব্যাপক সুপরিচিত, যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে বাণিজ্যিক কৃষিতে দিনে কয়েক হাজার বীজ বপন করে চারা স্থান্তরিত করা খুবই সাধারণ দৈনন্দিন ঘটনা। আর্টিফিসিয়াল ইন্টোলিজেন্স ব্যবহার করে বপন উপযোগী চারা সহজেই শনাক্ত করা যায় একই সাথে পরিপক্ব ফসল শনাক্ত করার পাশাপাশি ফসলের সম্ভাব্য ফলন বের করা যায়। কোন জমিতে কি পরিমাণ সার, বীজ, কীটনাশক প্রয়োজন তা সিমুলেশন মডেল থেকে পূর্বেই ধারণা পাওয়া যায়। স্যাটেলাইট দিয়ে ইমেজিং করে ফার্টি/ড্রোন ব্যবহার করে জমির ফার্টিলিটি নির্ণয় করে সার ও বীজ প্রয়োগ ও বপন করা যায়। একইভাবে ওড়ঃ ডিভাইস কাজে লাগিয়ে জমিতে চাহিদা অনুপাতে সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। এতে করে একদিকে যেমন পানির অপচয় রোধ করা যায় অন্যদিকে সঠিকসময়ে সেচের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা যায়।
বাংলাদেশের কৃষিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি
বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়ে উঠেছে শিক্ষা এবং আধুনিক কৃষি ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনার অংশ। ইতিমধ্যে কৃষিতেও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার শুরু হয়েছে। তারি ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ব্রি) ধানের রোগবালাই চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যে ‘রাইস সল্যুশন’ (সেন্সরভিত্তিক ধানের বালাই ব্যবস্থাপনা) নামক একটি মোবাইল অ্যাপস উদ্বোধন করা হয়েছে। যা, ধানের খেত থেকেই আক্রান্ত ধান গাছের ছবি দেখে রোগ চিহ্নিত করতে সক্ষম। ২ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার- কৃষিমন্ত্রী গাজীপুরে ব্রিতে অনুষ্ঠিত ছয় দিনব্যাপী বার্ষিক গবেষণা পর্যালোচনা কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এ মোবাইল অ্যাপসটি উদ্বোধন করেন।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, নেদারল্যান্ডসের টুয়েন্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র যৌথভাবে ‘স্টারস’ প্রকল্পের আওতায় দেশের কৃষি গবেষণায় আধুনিক, উন্নত ও কার্যকর প্রযুক্তি হিসেবে ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে।
কৃষি খাতে উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে “ই-ভিলেজ” নামক প্রকল্প শুরু করতে যাচ্ছে। সেন্সরের মাধ্যমে ফসল বা সবজির ক্ষেত থেকে বিভিন্ন তথ্য নিয়ে তা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে। “ই-ভিলেজ” নামক এই প্রজেক্টের মাধ্যমে ফসলি জমির মাটির স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানা যায়, ফসল সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণে রেখে ফসলে কোন রোগ দেখা দিয়েছে কিনা তা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সাথে সাথেই জানা যায় এবং সেই সাথে অ্যাপ থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে কৃষক তার উৎপাদন খরচ কমিয়ে সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে পারবেন। এই প্রজেক্টের আর্থিক সহায়তায় রয়েছে চীনা দূতাবাস।
কৃষিতে (AI) প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একদল তরুণ আইটি ইঞ্জিনিয়ার ও কৃষিবিদগণ যুগন্তকারী ‘ডা. চাষি’ মোবাইল এ্যাপ গুগোল প্লে-স্টোরে রিলিজ করেছেন। এ এ্যাপ দিয়ে পাওয়া যায়। ছাদ-বাগান এবং মাঠ ফসলের রোগ ও পোকামাকড়ের সঠিক তথ্য ও সমাধান। এ এ্যাপ দিয়ে ফসলের আক্রান্ত স্থানের ছবি তুলেই ‘ডা.চাষি’ বলে দিবে ফসলের সমস্যা ও সমাধান।
ড্রোনের সঙ্গে অও কাস্টমাইজ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ইন্টিগ্রেট করলে ড্রোন একবার ফসলের খেতের উপর দিয়ে উড়ে গেলে ঐ এলাকার যে সার্বিক অবস্থা জানান দিতে সক্ষম তা হলো ফসলের মাঠের আর্দ্রতা পরিমাপ; ফসলে উপাদানের উপস্থিতি নির্ধারণ; শস্য রোপণ ডিজাইন; বীজ বপন; পোকার আক্রমণ জানা (ইমেজ প্রযুক্তি); কীটনাশক স্প্রে; সেচ মনিটরিং; ফসলের উৎপাদন জানা; ফসলের সার্বিক মনিটরিং করা; মাটির নিউট্রেন্ট; আর্দ্রতা; তাপমাত্রা; পিএইচ; লবনাক্ততা ফসলের নিউট্রেন্ট এর অভাব ফসলের রোগ ও পোকামাকড়ের উপস্থিতি জানা, কৃষি ওয়েদার ফোরকাস্টিং এন্ড আগাম এলার্মিং দেয়া, ফসলের আগাম সম্ভাব্য ফলনের পূর্বাবাস দেয়া , কৃষি কলসেন্টার সেবা দেওয়া, সর্বোপরি কৃষিপণ্যের বাজারদর জানা।
স্মার্ট ফারমিং/কৃষিতে ডিজিটালাইজেশন, অর্থাৎ আগামীতে কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও প্রযুক্তি) সম্প্রসারণ ঘটিয়ে ; কৃষিকে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধদীপ্ত প্রযুক্তিভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার এখনই সময়।
লেখক : লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, মদিনা টেক লিমিটেড, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭৪১১২২৭৫৫, ই-মেইল :srb_ccdbseed@yahoo.com